Friday, 30 August 2019

হুমকিতে চা-শিল্প পঞ্চগড়ে

হুমকিতে চা-শিল্প পঞ্চগড়ে



বাজার দরের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি, আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা, দরপতনের জন্য চাষি এবং কারখানা মালিকরা পরস্পরকে দায়ী করছেন
সরকার হ্য়দার ঃ
দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ে কাঁচা চাপাতার দাম কমে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন পাঁচ হাজার ক্ষুদ্র চা-চাষি। বাজারে এখন চাপাতার দামের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি। বেশ কিছুদিন ধরেই কাঁচা চাপাতার দরপতন চলছেই। বিষয়টি দেখার কেউ নেই। ফলে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময়ী ‘চাশিল্প’ চরম হুমকিতে পড়েছে।

এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চা-চাষি ও কারখানা মালিকদের। চাষিদের অভিযোগ, কারখানা মালিকরা  সিন্ডিকেট তৈরি করে কাঁচা চাপাতার দাম কমিয়েছেন। কারখানা মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অভিযোগ, ক্ষুদ্র চাষিরা কাঁচাপাতা তুলতে নিয়ম মানছেন না বলে চায়ের মান কমে গেছে। তাই অকশন বাজারে ফিনিসড টি বা তৈরি চায়ের দাম কমে যাওয়ার কারণে কমেছে কাঁচা চাপাতার দামও। কাঁচা চাপাতার মূল্য বাড়ানোর জন্য চাষিদের নিয়ম মেনে কাঁচা চাপাতা সংগ্রহ ও ভালো চারা রোপণের পরামর্শ দিচ্ছে টি-বোর্ড।


পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ক্ষুদ্র চা-চাষি মোহাম্মদ জুবায়েদ ইকবাল রাহেল জানান, ‘সরকার নির্ধারিত চাপাতার দাম প্রতি কেজি ২৪ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু স্থানীয় ১৩টি চা কারখানার কর্তৃপক্ষ চাষিদের কাছ থেকে চাপাতা কিনছেন মাত্র ১০-১২ টাকায়। প্রতি কেজি চা উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১৪-১৫ টাকা। আবার ২০ থেকে ৩০ ভাগ পাতা কেটে নিচ্ছে চা কারখানা কর্তৃপক্ষ। চাষিরা ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার পেছনে দায়ী অকশন মার্কেটও। তারা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে চাপাতা কম দামে কিনছেন। ভোক্তা পর্যায়ে কিন্তু চায়ের দাম কমছে না।’
সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই পঞ্চগড় জেলার কাঁচা চাপাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি প্রতি কেজি কাঁচা চাপাতার দাম নির্ধারণ করে ১৬ টাকা ৮০ পয়সা। একবৃন্তে ৪ থেকে ৫ পাতার চাপাতা সরবরাহের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় চাষিদের। একইসঙ্গে কারখানা মালিকদের প্রতিবৃন্তে ৪/৫ পাতার বেশি কাঁচা চাপাতা না নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তারা এই নির্দেশনা মানছেন না। বরং নানা অজুহাত দেখিয়ে চাষিদের প্রতি কেজি কাঁচা চাপাতা কিনছেন ১০ থেকে ১২ টাকা দরে। ফলে চায়ের মান কমে যাচ্ছে। এসব কারণে পঞ্চগড়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন নতুন চাষিরা। তাই বিক্রি হচ্ছে না চায়ের চারা। লোকশান গুনতে হচ্ছে চারা উৎপাদনকারী চাষিদের। এ নিয়ে চাষিরা মানববন্ধন করে দাবি দাওয়া তুলে ধরলেও কেউই কর্ণপাত করছেন না। জানা যায়, ২০১৮ সালে পঞ্চগড়ে কাঁচা চাপাতার দাম ছিল কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কিন্তু এ বছর হঠাৎ করেই দাম কমে যায়। ক্ষুদ্র চা চাষিরা বলছেন, এই মূল্যে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। চা শ্রমিকদের মজুরি এবং সার-কীটনাশকের খরচ জোগাতে ঘর থেকে টাকা ঢালতে হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, কারখানার মালিকরা সিন্ডিকেট করে কাঁচা চাপাতার দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। দাম কম দেওয়ার পাশাপাশি কেজিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কাঁচা চাপাতার দাম কেটে রাখা হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করলে চাপাতা কেনা বন্ধ করে দেন তারা। তেঁতুলিয়া উপজেলার পেদিয়াগজ এলাকার ক্ষুদ্র চা-চাষি ফারুক হোসেন জানান, এক হাজার কেজি কাঁচা চা উৎপাদনে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। কারখানায় নিয়ে গেলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কেটে নিয়ে দাম পাই ৭ হাজার টাকা। চাষিরা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে চা কারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে, যাতে চাষিরা সময়মতো চাপাতা বিক্রি করতে না পারে। গত বছর চা মৌসুমে কারখানা মালিকরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা  কেজি দরে চাষির কাছ থেকে পাতা কিনেছেন। কিন্তু এ বছর মৌসুম শুরু হতেই কারখানা মালিকরা নানা টালবাহানা শুরু করেন।


সম্প্রতি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ক্ষুদ্র চাষিরা চাপাতার ন্যায্য মূল্যের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। পরে তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু ঘটনাস্থলে এসে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে সমঝোতার আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেন। এরপরও চাষিরা চায়ের ন্যায্য মূল্য দূরের কথা উৎপাদন খরচই পাচ্ছেন না। চা কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছেন, ক্ষুদ্র চা-চাষিরা গাছ থেকে চাপাতা সংগ্রহে নিয়ম মানছেন না। চাপাতার কালচার যথাসময়ে বজায় রাখছেন না। চাপাতার থিকনেস বাড়ানোর জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করায় চায়ের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। গ্রিন কেয়ার অ্যাগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মঞ্জুর আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, চাষিরা চাপাতার পরিপক্বতা ৪ থেকে ৫ না মেনে ১০/১২-এর  উপরে পাতা সরবরাহ করছেন। ফলে চায়ের মান কমে গেছে। এ কারণে অকশন মার্কেটে তৈরি চায়ের দরপতন ঘটেছে। কাঁচা চাপাতার মূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা। স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের তেঁতুলিয়া উপজেলা সভাপতি হাবিবুর রহমান হবি বলেন, ‘পঞ্চগড়ে সরকারিভাবে একটি চা কারখানা স্থাপন করার কথা ছিল, সেটি দ্রুত স্থাপন করা হোক। সেই সঙ্গে পঞ্চগড়ের সব চাষিকে চা একটি বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। সেখান থেকে কারখানা মালিকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী চা কিনে নিয়ে যাবেন।’

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios:

আপনার একটা সুন্দর মতামত দিন